রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০-১৫ অক্টোবর ২০২৫) ছবি - খালেদ সরকার
|

বিদায় তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান

গত ১৫ অক্টোবর মারা গেলেন জনপ্রিয় লেখক রকিব হাসান। 

রকিব হাসান সেবা প্রকাশনীতে “তিন গোয়েন্দা” কিশোর থ্রিলার সিরিজ লেখা কিশোর তরুণদের মাঝে প্রচুর জনপ্রিয়তা পান। 

ওইদিন আমি অফিসে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। লাঞ্চের সময় ফেসবুকে ঢুকে একটা গ্রুপে রকিব হাসানের ছবি দিয়ে একটা ফটোকার্ড দেখি যে উনি আর নাই। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না, ভেবেছিলাম এটাও হয়ত গুজব। কারণ ওইসময়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের মৃত্যুর গুজব ফেসবুক পেইজে পেইজে ভাইরাল। ভাবছিলাম রকিব হাসানেরটাও এমন কিছু হবে হয়ত। 

কিন্তু না, আশেপাশে আমার তিন গোয়েন্দা ভক্ত কলিগরা গ্রুপ চ্যাটে তাঁর মৃত্যুর খবর যখন শেয়ার করলো তখন বুঝলাম রকিব হাসান আমাদের মাঝে আর নাই। কাজের ব্যস্ততায় উনার মৃত্যুর খবরটা ভালো করে প্রসেস করতে পারছিলাম না। মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে রইলো সারাদিন। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বসতেই বউ বলল, তিন গোয়েন্দার লেখক আর বেঁচে নেই দেখছ? 

জিনিসটা তখণ মারাত্নক ভাবে মনের ভেতরে ধাক্কা মারল। এই লোকটার লেখা পড়ে সেই কিশোর বেলা থেকে নিজের কল্পনার রাজ্য সাজিয়েছিলাম, মনের ভেতরের যে কৌতূহলী ব্যাক্তিত্ব গড়ে উঠার পেছনে রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার অনস্বীকার্য ভূমিকা ছিলো। 

আমার মনে পড়ে, রকিব হাসানের লেখা প্রথম যে তিন গোয়েন্দা আমি হাতে নেই পড়ার জন্য –  বইটির নাম ছিলো “চাঁদের ছায়া”। আমার বড় আপুর বাসায় বইটি পড়েছিলাম। আপু ছিলেন বই পড়ুয়া, তাদের বাসায় গেলে তাঁর বই গুলো আমি পড়তাম। এভাবেই আমার তিন গোয়েন্দা পড়া শুরু।

চাঁদের ছায়া তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী

এরপর আপুর বান্ধবী আপুর তিন গোয়েন্দা কালেকশন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ও তাঁর আপুর তিন গোয়েন্দা কালেকশন থেকে বই ধার করে আস্তে আস্তে তিন গোয়েন্দার সব বই পড়ে ফেলতে শুরু করলাম। এরপর নিজের টিফিনের বা মেহমানদের কাছে পাওয়া গিফটের টাকা বাঁচিয়ে সিলেট খালার বাসায় আসলেই লাইব্রেরীতে গিয়ে তিন গোয়েন্দা কেনাটা একটা নেশা হয়ে গিয়েছিলো।

সেবার বইয়ের সাথে আমার পরিচয় এভাবেই, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা পড়ে পড়ে। 

অনেকে রকিব হাসানকে ডিসক্রেডিট করেন এই বলে যে উনি বিদেশী বইকে অনুবাদ করে এই সিরিজ লিখেছেন। কিন্তু এনারা এটা ভুলে যান, রকিব হাসান শুধু এখানে অনুবাদ করেন নি — সম্পূর্ণ নতুন কিছু চরিত্র আর আমাদের দেশী প্রেক্ষাপটে চমৎকার একটা জিনিস সৃষ্টি করে গেছেন। যেটার সাথে বাংলাদেশের লাখ লাখ কিশোরের ছোটবেলার সোনালি দিন, তাদের কৌতূহলী কল্পনার রাজ্যের আবেগ জড়িত। 

আমার শৈশবের সেই রোমাঞ্চকর বিকেলগুলো, যখন দুপুরের  আলোয় লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম ভয়ের রাজ্য বা অদৃশ্য আততায়ী-র পাতায়, সবকিছু যেন এখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। রকিব হাসান শুধু একজন লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের কল্পনার সঙ্গী, রহস্যের চাবিকাঠি। তিন গোয়েন্দার প্রতিটা পাতার রকিব হাসানের জাদুকরী শব্দের খেলায় তিন গোয়েন্দার দুনিয়া যেন আমার সামনে ভেসে উঠত।  

তাঁর চলে যাওয়ায় আমি ব্যথিত, গভীরভাবে। এই লেখাটি শুধু একটা বিদায় নয়, একটা শ্রদ্ধাঞ্জলি। যাতে তাঁর জীবন সবার সামনে তুলে ধরতে পারি, যাতে আমরা সবাই মনে রাখি এই অসাধারণ মানুষটিকে।

রকিব হাসানের সাধারণ শুরু, অসাধারণ যাত্রা

রকিব হাসানের জন্ম হয় ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায়। তাঁর পুরো নাম ছিল আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব, কিন্তু আমরা পাঠকেরা তাঁকে চিনেছি শুধু ‘রকিব হাসান’ নামে। বাবার চাকরির কারণে তাঁর শৈশব কেটেছে ফেনীতে, যেখান থেকে তিনি এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেন। পরবর্তীতে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি লেখালেখির পথ বেছে নেন, কোনো নিয়মিত চাকরি বা কর্মক্ষেত্রের বাঁধন ছাড়াই। এটাই ছিল তাঁর স্বাধীনতা, যা পরে তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।

তাঁর জীবন ছিল সাধারণ, কিন্তু লেখার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসীম। সেবা প্রকাশনীতে যুক্ত হয়ে তিনি লেখালেখি  শুরু করেন অনুবাদ দিয়ে। বিদেশি ক্লাসিকগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে তিনি আমাদের মতো পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন এক নতুন জগতের সাথে। তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদের মধ্যে রয়েছে ব্র্যাম স্টোকারের ড্রাকুলা, ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো, এবং আরও অনেক সব কিশোর ক্লাসিক। এই অনুবাদগুলো আমাদের জন্য শুধু বই নয়, এগুলা ছিল একটা সেতুর মতোন, পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা পাঠকের। নামে-বেনামে তিনি চারশতাধিক বই লিখেছেন, যার মধ্যে থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনী, এমনকি টারজান বা গোয়েন্দা রাজু-এর মতো সিরিজও রয়েছে। কিন্তু তাঁর আসল জনপ্রিয়তা তিনি পান তিন গোয়েন্দা লেখার মাধ্যমে।

হারানো উপত্যকা তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী

তিন গোয়েন্দা: বাংলা রহস্যের জগতে এক বিপ্লব

১৯৮৫ সালের আগস্টে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রথম তিন গোয়েন্দা বইটা বের হয়। এটা ছিল আমেরিকান লেখক রবার্ট আর্থারের দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজের ছায়ায় অনুপ্রাণিত, কিন্তু রকিব হাসানের হাতে এটা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ বাংলাদেশি এক কিশোর থ্রিলার সিরিজ। জনপ্রিয় তিনটি চরিত্রের জন্ম দেন রকিব হাসান যাদের সাথে বাংলাদেশের লাখ লাখ কিশোর তরুণ মায়ায় জড়িয়ে পড়ে, 

কিশোর পাশা 

মুসা আমান 

রবিন মিলফোর্ড 

‘তিন গোয়েন্দা’ বই খুললেই প্রথমেই যে লেখা চোখে পড়ত,

হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—

আমি কিশোর পাশা বলছি অ্যামিরিকার রকি বিচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনো আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম তিন গোয়েন্দা।

আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচির কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো। অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ছি আমরা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরোনো এক মোবাইল হোমে আমাদের হেডকোয়ার্টার। নতুন এক রহস্যের সমাধান করতে চলেছি আমরা। চলে এসো আমাদের দলে।

উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমি ডুবে যেতাম রহস্যের দুনিয়ায়, কিশোর মুসা রবিনদের সাথে নতুন কোন কেইস সমাধানে! 

যারা আমেরিকার ফিকশনাল শহর রকি বীচ থেকে নানান  রহস্যের সমাধান করে। এই সিরিজটা শুধু সাধারণ গোয়েন্দা কাহিনী নয়, ছিল আমাদের মতো কিশোর-কিশোরীদের মনের কল্পনাকে উড়তে দেওয়ার একটা মাধ্যম। একটানা ১৬০টিরও বেশি ভলিউম লিখেছেন তিনি এই সিরিজে, যা বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের পাঠকের কাছে অমর হয়ে আছে।

রকিব হাসান ছিলেন ভীষণ প্রচারবিমুখ। ইন্টারভিউ দিতেন না, স্পটলাইট এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু তাঁর লেখায় সেই সরলতা, রোমাঞ্চ আর বুদ্ধির খেলা এতটাই জীবন্ত ছিল যে, আমরা পাঠকরা তাঁকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছি। তিন গোয়েন্দা শুধু বই নয়, ছিল একটা সংস্কৃতি। স্কুলের ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, রাত জেগে পড়া,দুপুরের খেলা বাদ দিয়ে শুধু তিন গোয়েন্দা নিয়েই পড়ে থাকা।  আমার জন্যও তাই ছিল; তাঁর লেখা আমাকে শিখিয়েছে যে, রহস্যের সমাধান সবসময় বাইরে নয়, মনের গভীরে।

রকিব হাসান শুধু তিন গোয়েন্দাই লিখেন নি। তাঁর হাত ধরে এসেছে গোয়েন্দা রাজু সিরিজ যা তিনি “আবু সাইদ” ছদ্মনামে লিখতেন। এছাড়া ছিলো দুই ভাই রেজা সুজা সিরিজ যা তিনি “জাফর চৌধুরী” ছদ্মনামে লিখতেন। এই বইগুলো রকিব হাসান পরে নিজেই তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর করেন। “শামসুদ্দীন নওয়াব” ছদ্মনামে তিনি অনেক বিদেশী বইও অনুবাদ করেছিলেন। উনার অনুবাদ যারা পড়েছেন আপনারা স্বীকার করতে বাধ্যই হবেন যে উনি বাংলাদেশের সেরা অনুবাদকের মাঝে একজন! 

একটা সোনালি যুগের অবসান

তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী
রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০-১৫ অক্টোবর ২০২৫) ছবি – খালেদ সরকার (প্রথম আলো)

১৫ অক্টোবর ২০২৫, এই তারিখটা আমি ভুলব না। রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হঠাৎ হৃদয়ের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে চলে যান রকিব সাহান। বার্ধক্যজনিত জটিলতা, দুটো কিডনির বিকল হয়ে যাওয়া, এসব ছিল শেষের কথা। কিন্তু তাঁর লেখা অমর হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেবার গ্রুপ আর ফেসবুকে আমার মতো পাঠকদের লেখা পড়ছিলাম, কিভাবে রকিব হাসান তাঁর লেখা দিয়ে, তিন গোয়েন্দা দিয়ে আমাদের শৈশব কৈশোরকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে গেছেন। উনার এই অবদান আমরা ভুলব কি করে? 

রকিব হাসানের চলে যাওয়া শুধু একজন লেখকের বিদায় নয়, একটা যুগের অবসান। আমরা যারা তাঁর পাঠক, আমরা হারিয়েছি আমাদের শৈশবের নায়ককে। কিন্তু তাঁর লেখায় তিনি সবসময় থাকবেন, তিন গোয়েন্দার প্রতিটা পাতায়, প্রতিটা রহস্যের সমাধানে। 

বিদায়, রকিব হাসান। আপনার তিন গোয়েন্দারা আমাদের হাত ধরে নিয়ে যাবে নতুন অ্যাডভেঞ্চারে। আল্লাহ আপনার জান্নাতে আশ্রয় দিন। আমীন। 

আমার পছন্দের তিন গোয়েন্দা বই 

আমার মতে প্রথম দিকের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ এর মধ্যে যে কাহিনীগুলো ভলিউমে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটা কাহিনীই সেরা। তবে আমাকে যদি আলাদা করে বলতে হয় তাহলে আমি বলব তিন গোয়েন্দার ভলিউম ওয়ানের তিনটা কাহিনী আমার কাছে অনেক প্রিয়। 

১. তিন গোয়েন্দা (ভলিউম ১/১, ১৯৮৫)

তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী

কাহিনী সারাংশ: কিশোর, মুসা ও রবিন —তিন কিশোর গোয়েন্দা—প্রথমবারের মতো একটা ভয়ঙ্কর দুর্গের রহস্য উন্মোচন করে। একটা পরিত্যক্ত দুর্গে অদ্ভুত শব্দ আর ছায়ামূর্তির খেলায় তারা জড়িয়ে পড়ে, যা একটা প্রাচীন গুপ্তধনের সাথে জড়িত।

কেন জনপ্রিয়?: সিরিজের প্রথম বই, যা পাঠকদের চরিত্রগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। গুডরিডসে ৪.৪৬ রেটিং (১২৬৭+ রিভিউ)—অনেকের শৈশবের প্রথম রোমাঞ্চ।

২. কঙ্কাল দ্বীপ (ভলিউম ১/১, ১৯৮৫)

কঙ্কাল দ্বীপ তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী

কাহিনী সারাংশ: একটা দ্বীপে কঙ্কালের মতো অদ্ভুত আবিষ্কারের পর তিন গোয়েন্দা একটা পুরনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এবং লুকানো সোনার খোঁজে যায়। সমুদ্রের ঝড়, জলদস্যুরা—সব মিলিয়ে থ্রিলারের চরম।

কেন জনপ্রিয়?: অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা এবং দ্বীপের রহস্য পাঠকদের মুগ্ধ করে। ৪.২৫ রেটিং (৭৫৫+ রিভিউ)—অনেকে এটাকে ‘সেরা দ্বীপ অ্যাডভেঞ্চার’ বলে।

৩. রূপালী মাকড়সা (ভলিউম ১/১, ১৯৮৫)

রুপালি মাকড়সা তিন গোয়েন্দা রকিব হাসান সেবা প্রকাশনী

কাহিনী সারাংশ: একটা রাজকীয় দ্বীপে রূপালী মাকড়সার মূর্তি চুরির ঘটনায় তিন গোয়েন্দা জড়িয়ে পড়ে। রাজপরিবারের গুপ্তধন এবং আন্তর্জাতিক চোরেরা—রহস্যের জাল ছড়িয়ে যায়।

কেন জনপ্রিয়?: ঐতিহাসিক উপাদান আর চতুরতার খেলা এটাকে অসাধারণ করে। ৪.৪৪ রেটিং (৮৪৭+ রিভিউ)—পাঠকরা এর ‘ইন্টেলিজেন্ট প্লট’-এর জন্য ভালোবাসে।

তিন গোয়েন্দার ইতিহাস

রকিব হাসান প্রথমে সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রস্তাব দেন কিশোরদের জন্য নতুন এক গোয়েন্দা কাহিনী শুরু করতে। তখন কুয়াশা সিরিজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আনোয়ার হোসেন রাজি হন, এবং ১৯৮৫ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয় প্রথম বই “তিন গোয়েন্দা”

২০০৩ সাল পর্যন্ত রকিব হাসান লেখেন, এরপর লেখার দায়িত্ব নেন শামসুদ্দিন নওয়াব নামের আড়ালে সেবার অন্যান্য লেখকরা। উনারা নতুন চরিত্র কাকাতুয়া কিকো যোগ করেন এবং বিদেশি লেখক যেমন এনিড ব্লাইটন, ক্রিস্টোফার পাইক প্রমুখের গল্প অবলম্বনে কাহিনী লিখেন। পুরনো বইগুলো পরে ভলিউম আকারে প্রকাশিত হয়।

তিন গোয়েন্দা মূলত আমেরিকার জনপ্রিয় সিরিজ The Three Investigators (১৯৬৪–১৯৮৭) থেকে অনুপ্রাণিত, যেখানে ছিল ৪৩টি বই। পরবর্তীতে Crime Busters (১৯৮৯–১৯৯০) নামে নতুন ১১টি বই প্রকাশিত হয়।

তিন গোয়েন্দার চরিত্রগুলো এসেছে বিভিন্ন বিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ থেকে —

  • Famous Five (এনিড ব্লাইটন) সিরিজের চরিত্ররা রূপ নিয়েছে কিশোর, মুসা, রবিনে।
  • Secret Seven সিরিজ থেকে তৈরি হয়েছে গোয়েন্দা রাজু সিরিজ, যা পরে তিন গোয়েন্দায় রূপান্তরিত হয়।
  • Hardy Boys সিরিজের গল্প থেকে তৈরি হয়েছে রোমহর্ষক (রেজা-সুজা) সিরিজ, যা পরেও তিন গোয়েন্দায় যুক্ত হয়েছে।

সবশেষে, ক্রিস্টোফার পাইক-এর কিছু ভৌতিক ও রোমাঞ্চকর গল্প থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছে তিন গোয়েন্দার কাহিনী।

তিন গোয়েন্দা হলো তিনজন কিশোর — কিশোর পাশা, মুসা আমান, আর রবিন মিলফোর্ড — যারা রকি বীচ শহরে বসবাস করে এবং রহস্য সমাধান ও অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নেয়।

  • কিশোর পাশা দলের নেতা। সে খুব বুদ্ধিমান, মনে রাখার ক্ষমতা শক্তিশালী, ইলেকট্রনিক্সে পটু, এবং চিন্তা করার সময় নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটে। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারায় এবং চাচার কাছে মানুষ হয়।
  • মুসা আমান আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, হাসিখুশি ও শক্তিশালী। ভয় পেলেও বিপদের সময় সাহস দেখায়। মাঝে মাঝে “খাইছে”, “সেরেছে”, “ইয়াল্লা” ইত্যাদি বলে। খাবারপ্রেমী এবং কখনো কখনো মজার পরিস্থিতি তৈরি করে।
  • রবিন মিলফোর্ড দলের নথি গবেষক। সে পড়ুয়া, ভদ্র, চশমাধারী, আর বই থেকে তথ্য উদ্ধৃত করতে ভালোবাসে। দলের মধ্যে সবচেয়ে কেতাদুরস্ত ও ভাবুক স্বভাবের।

সহায়ক চরিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো জর্জিনা পার্কার (জিনা) — দুঃসাহসী এক মেয়ে, যার কুকুরের নাম রাফি। সে প্রায়ই তিন গোয়েন্দার সঙ্গে অভিযানে যায়।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্ররা হলেন:

  • ডেভিড ক্রিস্টোফার, বিখ্যাত পরিচালক, যিনি তিন গোয়েন্দাকে প্রথম রহস্য সমাধানের সুযোগ দেন।
  • ভিক্টর সাইমন, একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা, যিনি তাদের অনেক কেস দেন।
  • ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, রকি বীচের পুলিশ চীফ, তিন গোয়েন্দাকে অফিসিয়ালি সহায়তা করেন।
  • ওমর শরীফ, সাহসী বৈমানিক ও তাদের বন্ধু। (আমার প্রিয় একটা চরিত্র)
  • শুঁটকি টেরি, তিন গোয়েন্দার প্রতিদ্বন্দ্বী দুষ্টু চরিত্র।

তাদের একটি গোপন ঘাঁটি আছে, যার নাম হেডকোয়ার্টার—একটি পুরনো ভ্যানে তৈরি ঘর, যেখানে পেরিস্কোপ, টেলিফোন, রিপোর্ট রাখার জায়গা ইত্যাদি আছে। সেখানে প্রবেশের জন্য রয়েছে গোপন পথ — “সবুজ ফটক এক”, “দুই সড়ঙ্গ” ইত্যাদি নামে।

তারা নিজেরা ‘তিন গোয়েন্দা’ লেখা বিশেষ কার্ড ব্যবহার করে, যাতে প্রশ্নবোধক (?) বা আশ্চর্যবোধক (!) চিহ্ন থাকে। (ছোটবেলা নিজেদের নিয়ে এইরকম কার্ড হাতে লিখে বানিয়ে আমরা তিন গোয়েন্দা খেলতাম)
তথ্য সংগ্রহের জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো “ভূত-থেকে-ভূতে”, যেখানে বন্ধুরা একে অপরকে ফোন করে খবর ছড়ায়।

(বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে)

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.