|

শেরি | উপন্যাস | প্রথম পর্ব

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। তার চোখের পানি টলমল করছে। আমি ভয় করছি সেই পানি না চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। কারণ সে চোখে কাজল মেখে আছে, চোখের পানি গড়িয়ে পড়লেই যে কাজলটা নষ্ট হয়ে যাবে!
আমি আসব শুনলেই সে চোখে কাজল দেয়। আমিই একদিন বলেছিলাম কাজল চোখে মেয়েদের মায়াময় লাগে। এরপর থেকেই আমি বাসায় আসব শুনলেই চোখে কাজল দেওয়াটা তার রুটিন হয়ে গেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। হালকা লালচে চুলগুলো তার কাটা দিয়ে শক্ত করে খোপা করে বাঁধা। আমি এটা নিশ্চিত আমি যদি বলি কালো চুলেই মেয়েদের আমার ভালো লাগে তাহলে পরের দিনই দেখব তার মাথার চুল ঘন কালো। অবশ্য এমন না যে তার এই লালচে কালো চুল আমার অপছন্দ। 
 
আজ সে গোলাপী কালারের একটা টিশার্ট পরে আছে ডোরাকাটা পায়জামার সাথে। বুকের কাছে একটা বই ধরা, প্রেমের উপন্যাস। আমার বাম হাতটা ঐ বই সহ বুকে ধরে আছে সে। পালংকের কাছে, নিচে মেঝেতে বসেছি আমরা। আমি একটু ঝুকে আছি ওর দিকে। বেকায়দায় বসা তারপরও কিছু বলছি না। জানি, আমি কিছু একটা বললেই ওই দুচোখ বানের জলে ভেসে যাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে। 
 
এইসব নতুন না। মাঝে মাঝেই তার ফোন পেলে আমার সব কিছু ফেলে তার কাছে ছুটে আসতে হয়। ফোনে শুধু একটি কথাই বলে সে, ‘আমার কাছে আসো প্লিজ!’ এটা শোনার পর কি আর দূরে থাকা যায়। আমি তো জানি একটু প্রান খুলে কাঁদার জন্যই আমাকে ডাকে সে। 
 
 

আমি তাকে আলতো করে নিজের দিকে টেনে আনি। আমার কাঁধে মাথা রাখতেই তার চোখের জল বাঁধ ভাঙে। তখনো আমার একটি হাত তার হাতের মাঝে। কোন শব্দ না হলেও বুঝি তার চোখের জলে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। প্রথমবার এই কান্ডটা সে যখন করেছিল তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সারারাত জেগে সেদিন ঘুমিয়েছিলাম মাত্র ফজরের নামাজের পর। সাতটায় তার ওই কন্ঠ শুনে কোন রকমে প্যান্ট পড়ে মুখ না ধুয়েই ছুটে এসেছিলাম। সেই কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে আমার বুক ধুপধাপ করে বাড়ি খাচ্ছিল। দরজা খুলে আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে এসেছিল। তখনো ওদের বাসার কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক যেমন আজকের মত হাত ধরে বসেছিল মেঝেতে। আমি প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠেছিলাম, কি হয়েছে ওর? বারবার কাঁধ ধরে ঝাকাচ্ছিলাম। একসময় কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে চোখের পানিতে আমার টিশার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিল সে। একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেদিনের পর আরো বেশকবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করলেও পরে ওর সাথে চলাফেরায় ওর চোখের ভাষা আমি বুঝে নিয়েছি। তাই এখন আর জিজ্ঞেস করতে হয় না।
তার হাত থেকে বইটি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই কাহিনীরও কি নায়ক মারা গেছে? সে আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। চোখের দুপাশে জলের ধারা শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক হাসি হেসে সে বলল, তোমার জন্য কড়া লিকারের চা নিয়ে আসছি। আমি হাসলাম। সেই প্রথম দিনের মত। সে জানে আমি কড়া লিকারের চা খুব খাই।
আমি কি শেরিকে ভালোবাসি? বা শেরিও কি আমাকে ভালোবাসে? গত ছয় মাসে শেরির সাথে পরিচয়ের পর এই প্রশ্নটা বার কয়েক মাথায় খেলা করলেও আমি কখনো এর উত্তর খুঁজতে যাই নি। আমার মনে হয় শেরিও এর উত্তর খুঁজতে যায় নি। আমরা শুধু একজন আরেকজনের সঙ্গই উপভোগ করে যাচ্ছি।
শেরির সাথে আমার প্রথম পরিচয়টা কি প্রায় সিনেমার সিনের মতই ছিল না?! আমার বন্ধু রিশি শুনে বলেছিল, আরেহ শালা এতো দেখি পুরাই সিনেমার কাহিনী। অবশ্য আমি তা মনে করি না। 
 
শেরির সাথে প্রথম পরিচয়টা লাইব্রেরীতে। সুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’ বইটার দাম আমি সবে পরিশোধ করেছি। পেছন থেকে শুনতে পেলাম একটা কন্ঠ, বইটার কি এক কপিই ছিল? 
 
আমাকে উদ্দেশ্য করে নয়, কাউন্টারের কর্মচারীকে উদ্দেশ্য করে বলা। তারপরও মোহময় সেই মিষ্টি কন্ঠকে উপেক্ষা করা আমার মত নিষ্ঠুরের পক্ষেও সম্ভব হয় নি। শরীর ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই প্রথমেই তার মায়াময় দুচোখে চোখ আটকে গিয়েছিল। গভীর কালো চুখগুলো যেন আমাকে হাজার ফিট গভীর পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল তাৎক্ষণিক! গোলগাল মুখ, খানিকটা খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট গুলো মুক্তোর মত সাদা দাঁত গুলো আড়াল করে রেখেছিল। হালকা পাতলা গড়নের সাথে তার মিষ্টি কন্ঠটা একদম খাপ খাইয়ে গিয়েছিল। 
 
যে আমি সব সময় অপরিচিত মেয়েদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলা এড়িয়ে চলি সেই আমি যেন কোন এক অদ্ভুত মায়ার টানে তার দিকে এক কদম এগিয়ে গেলাম। বইটা তুলে ধরে বললাম, আপনি এটা নিতে চান? 
 
একটু অবাক হয়েছিল শেরি, “নিতে চাইছিলাম কিন্তু এখানে তো আর কপি নাই। লাস্ট যেটা ছিল তা তো আপনি কনে ফেললেন।” শেরি এমন অসহায়ভাবে মুখ করে কথাটা বলেছিল যে আমি হেসে ফেলেছিলাম। 
 
“ওমা, হাসছেন যে!” ভুরু দুটো উপরে তুলে বলল সে। আমি বইটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আপনি এটা নিতে পারেন। আমার বইটি পড়া আছে। শুধুমাত্র সংগ্রহে রাখার জন্য কিনেছি। “না না এটা আমি কিভাবে নিব। আপনি তো দাম দিয়ে কিনেছেন,” শেরির উত্তর। 
 
আমি আমার সেই বিখ্যাত টোলপড়া হাসি মুখে এনে বলেছিলাম, ‘ধরে নিন এটা আমি আপনাকে গিফট করেছি।’ অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল সে। ‘ আপনি নিশ্চয় সুনীলের লেখার অনেক ভক্ত। অর্ধেক জীবন পড়ে আপনি অনেক মজা পাবেন।’ তার চোখে চোখ রেখেই বলেছিলাম আমি। 
 
তারপর পাক্কা এক ঘন্টা সেই লাইব্রেরীতেই ছিলাম আমরা। সুনীল দিয়ে শুরু করে, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সমরেশ, হুমায়ূন আহমেদ আর সাহিত্য নিয়ে হেন কথার বাকি ছিল না। নিজেদের সাহিত্য রুচির অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলাম একজন আরেকজনের কাছে। সময় যেন ফুরুৎ করে মিলিয়ে গিয়েছিল। আমার বেয়াড়া ফোনটা বেজে উঠায় আড্ডায় ছেঁদ পড়েছিল। বিদায় নেবার আগে অর্ধেক জীবন বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম ‘শেরি নামের মিষ্টি মেয়েটাকে অচেনা একটা বাউন্ডুলের সামান্য উপহার।’ 
 
লেখাটা পড়ে তার মায়াময় চোখটা তুলে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল শেরি। বেশ খানিকটা মুহুর্ত পর নিজের মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আপনার নাম্বারটা দিবেন প্লিজ! মিষ্টি সেই কন্ঠের আবদার ফেরানোর শক্তি আমি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। 
 
নিজের নামে নাম্বারটা সেভ করে দিয়ে রাস্তায় বের হয়ে মনে হয়েছিল আমি হাজার বছরের তৃষার্ত! ঠোঁট গলা শুকিয়ে কাঠ! এরকমতো কখনো হয়নি আমার কোন মেয়ের সামনে পড়ে। তবে আজ কেনো হলো!
 
সে রাতে তার ফোন পাওয়ার পর এই অবস্থা হয়েছিল। তারপর? এভাবেই শুরু। শেরির চায়ের অপেক্ষা করতে করতে আমার সব কিছু ফ্ল্যাশব্যাকের মত মনে পড়ছিল। 
 
শেরির রুম ছেড়ে বাইরে ওদের বাগানটায় চলে এলাম আমি। শেরিদের বাড়িটা একতলা। সুন্দর ছিমছাম সাদা বাড়ি। বাদিকে খুব সুন্দর একটা ফুলের বাগান। শেরির বাবার ফুলের বাগান করার শখ আছে। 
 
আমি জানতাম এই সাত সকালে আংকেলকে বাগানে পাওয়া যাবে। একটা গোলাপের চারার মাটি নাড়ানি দিয়ে ঝুরঝুর করে দিচ্ছিলেন আংকেল। 
 
‘গুড মর্নিং আংকেল’, পেছনে ফিরে আমাকে দেখেই মুখটা তার হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ‘গুড মর্নিং ইয়াং ম্যান’ মেয়ের মত বাবার হাসিটাও চমৎকার। অবশ্য শেরির মায়ের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। 
 
‘আহ! সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার মজাই আলাদা তাই না! এই সুন্দর শান্ত বাতাস কি অন্য সময় পাওয়া যাবে? তা কখন এসেছ? চা টা খেয়েছো?’ 
 
আমার সাতসকালে এভাবে আগমন এখন শেরির বাবা মার জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অনেক সময় দেখা যায় সকালটা আমার আংকেলের সাথে আড্ডা দিয়ে বাগানে সময় কাটিয়ে চলে যায়। তবে এক্ষেত্রেও আমার কোন অনুযোগ নেই। আংকেলের সঙ্গ কখনোই বোরিং মনে হয় না। এক সময় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, এখন রিটায়ার্ড। গল্প বলে মুগ্ধ করার অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা আছে ভদ্রলোকের। 
 
‘না আংকেল। শেরি চা বানাতে গেছে। আপনার জন্য বলব?’ ‘নাহ ঐ যে আমি খেয়েছি।’ এক পাশের টেবিলে রাখা চায়ের কাপ দেখালেন আংকেল, ‘তুমি কিন্তু আমার সাথে নাস্তা না করে যাবে না।’
আমি মিষ্টি হেসে বললাম, অবশ্যই আংকেল।
আংকেল আবার নাড়ানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাগানে গোলাপের গন্ধে অদ্ভুত মাদকতা। শান্ত প্রকৃতি, হালকা ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। 
 
একটু দূরে আমার শেরিকে চোখে পড়ল। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। গলায় হালকা নীল একটা ওড়না ঝুলিয়েছে। বাগানের ছোট রাস্তা দিয়ে গুটিগুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে সে।
তার ঐ মিষ্টি চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ মনে হলো বাগানের এই গোলাপের গন্ধ আর ঐ স্নিগ্ধ চেহারা ছাড়া আমার চারপাশে আর কিছু নেই। 
 
আংকেল গোলাপ নিয়ে কিছু বলছিলেন তার কিছুই আমার কানে ডুকছিল না। শেরি কাছে এসে চায়ের কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে। আমি শুধু ঠোঁট টিপে হাসলাম। এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ এই মিষ্টি মেয়েটার হাতেই আমি প্রতিদিনকার সকালের চা টা খেতে চাই এই ক্ষুদ্র জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত! 
 
শেরি (উপন্যাস/ প্রথম পর্ব) — নিশাত শাহরিয়ার
লেখার সময়কাল -৫.০৯.১৬ / রাত ২ টা 

পড়ুন নিশাত শাহরিয়ারের অন্যান্য লেখাঃ

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.